এনামুল হক কাশেমী, বান্দরবান::
পাহাড়ে প্রাণীকুলের পানির তৃঞ্চা মেটানোর প্রধান উৎস গিরি–ঝিরি থেকে নিঃসৃত পানি। এ পানিকে ধরে রেখেছে বোল্ডার পাথর বা প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি পাথরের কণা আর কণা। সরকারি উন্নয়ন কাজের অজুহাতে নিষিদ্ধ বিস্ফোরক ব্যবহার করে যখন পানির প্রধান উৎসব গিরি–ঝিরি থেকে অবাধে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন এবং পাচার চলছে,সে কারণে অচিরেই মানববসতি ছাড়াও পাহাড়ে বিচরণকারী প্রাণীকুলের বসবাস ক্রমশঃ লুপ্ত হওয়ার চরম আশংকা বিরাজ করছে বান্দরবান, রাঙামাটি এবং খাগড়াছড়ি জেলার ২৬টি উপজেলায়।
স্থানীয় সচেতন নাগরিকরা এসব অভিযোগ তুলেছেন সাংবাদিকদের কাছে। তারা বলছেন, পাহাড়ের অংশ ধবংস এবং প্রবাহমান পানির উৎসব বন্ধ করে অবৈধভাবে বোল্ডার পাথর উত্তোলন এবং পাচার কাজ বন্ধে প্রশাসন ও সরকারি মহলে বহুবার আবেদন–নিবেদন করা সত্বেও অবৈধ পাথর উত্তোলন রোধে কোন মহলই এযাবত স্থায়ী কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। নেই কোন উদ্যোগও।
পার্বত্য তিন জেলায় চলমান সরকারের উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার গতি আরও বাড়ানোর দাবি তুলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সমাজনেতারা বলছেন, পার্বত্যাঞ্চলের মাটি–মানুষের জীবন–মরণের প্রধান উপজীব্য পানির উৎস ধ্বংস ব্যতিরেকে উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যথায় পার্বত্য এলাকা প্রাকৃতিক পানি শুন্য হয়ে পড়বে, তখন বিপর্যয় ঘটবে সর্বক্ষেত্রেই। মানুষ এবং প্রাণীকুলের বসবাসে অনুপযোগী হয়ে পড়ার সমুহ আশংকা রয়েছে।
জানা গেছে, পার্বত্য অঞ্চলে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ মর্মে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত থাকা সত্বেও কথিত উন্নয়ন কাজে নিয়োজিত সরকারি সংস্থাগুলোর ছত্রছায়ায় বান্দরবান জেলার আলীকদম, লামা, রুমা, রোয়াংছড়ি, থানচি, নাইক্ষ্যংছড়ি এবং বান্দরবান সদর উপজেলার দুর্গম এলাকাসমুহের পাহাড়ি গিরি–ঝর্ণায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৃক্রিমবাঁধ দিয়ে প্রবাহমান পানি বন্ধ করে দিবারাতে অবাধে পাথর উত্তোলন এবং পাচার বা সরবরাহ করা হচ্ছে। জেলার উপজেলা সদরে পাথর সরবরাহকারী ঠিকাদাররা প্রাকৃতিক পানির উৎসবেষ্টিত পাথর তুলে নানাস্থানে স্তূপ করে পাচার করছে,কোন কোন এলাকায় প্রতিঘনফুট পাথর ৭০ থেকে ৮০ টাকা দামেও বিক্রি করছে কথিত উন্নয়ন কাজের স্থলে।
গুরুতর অভিযোগ রয়েছে–খোদ সেনাবাহিনীর নির্মাণ প্রকৌশল ব্যাটালিয়ন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনায় সড়ক নির্মাণের কাজে স্বাভাবিক ব্যবহার অনুপযোগী লাখ লাখ ঘনফুট বোল্ডার পাথর উত্তোলন করানো হচ্ছে। তবে সেনাবাহিনীর নির্মাণ প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তারা বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন–তারা পাথর উত্তোলন ও সরবরাহের কোন দায়িত্ব কাউকে দেয়নি বলেও দাবি করেন।
উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সময়ে সময়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয় এবং পাথর শ্রমিকদের গ্রেফতার করাসহ কিছু পাথরও জব্দ করা হয়। কিন্তু পানির উৎস ধংস করে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন স্থায়ী বন্ধে এখনও কোন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।
জেলার আলীকদম উপজেলা সদরের নাগরিক আবু সালাম ও আনোয়ার হোসেন বলেন, এ উপজেলার মাতামুহুরী সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কয়েকটি এলাকা,বাজারসহ কমপক্ষে ১০টি স্থান থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন এবং তা পাচার করা হচ্ছে রাতের অন্ধকারেই। গত ৩ বছর ধরে পাথর পাচার কারবার দিব্যি চললেও পুলিশসহ সরকারি বাহিনীগুলোর বিশাল বহরের টহলদল ও চেকপোষ্ট বরাবরই নির্বিকার থাকছে রহস্যজনকভাবে। ফলে পাথর পাচারকারীরা ক্রমেই বেপরোয়া বনে যাচ্ছে বলেও গুরুতর অভিযোগ রয়েছে নাগরিকদের পক্ষ থেকে।
লামা উপজেলার ইয়াংছা,ফাইতং এবং তীরের ডেবাসহ দুর্গম এলাকাসমূহ থেকেও অবাধে পাথর উত্তোলন ও তা পাচার চলছে। একইভাবে রুমাসহ জেলার সবগুলো উপজেলায় কথিত সরকারি উন্নয়ন কাজের অজুহাতে প্রবাহমান পানির ঝিরি থেকে প্রকাশ্যেই পাথর উত্তোলন কারবার চলছে। ফলে এসব এলাকায় স্বাভাবিক জনজীবন চরমভাবে ব্যাঘাত হচ্ছে খাবার ও ব্যবহারের পানির সংকটে। অন্যদিকে রাংগামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলার সবগুলো উপজেলাতেও একই কায়দায় পানির উৎস ধংস করে অবাধে পাথর উত্তোলন এবং তা পাচার কাজ চলে আসছেন বিনা–বাধায়।
পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নয়ন কাজের অজুহাতে গত তিনবছর ধরে পার্বত্য অঞ্চল থেকে যেভাবে পাথর উত্তোলন ও পাচারযজ্ঞ চলছে,তাতে চরম আশংকা করা হচ্ছে, পরিবেশ বিপর্যয় ও প্রবাহমান পানির উৎস বন্ধ হবার। ফলে পানির চরম সংকট নেমে আসবে আগামীতে পাহাড়ে।
এই বিষয়ে উপজেলা জেলা প্রশাসন কর্মকর্তারা বলছেন, জনবসতিপুর্ণ এলাকার আশেপাশে গিরিঝিরিসহ প্রবাহমান পানির উৎস বাদ দিয়েই সরকারি উন্নয়ন কাজের স্বার্থে পাথর সংগ্রহ করতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এই নির্দেশনা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সরকারি কর্মকর্তারা দাবি করেন, সাম্প্রতিক সময়ে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের দায়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে রুমা, থানচি এবং আলীকদম উপজেলায় বেশকজন পাথর শ্রমিককে স্পট থেকে আটক করে কারাগারেও পাঠানো হয়েছে। এমনকি কোথাও কোথাও পাথর জব্দপুর্বক জরিমানাও আদায় করা হয়েছে।
বান্দরবান জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো.সোহরাব হোসনে বলেন, পাহাড় ও গিরিঝর্ণার পাথর এবং পাহাড়ের ভেতরে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হওয়া বোল্ডার পাথরই একমাত্র পানির উৎস এবং পানির সংরক্ষণ ধরে রাখে। সাধারণ পাহাড়ি এলাকায় ভাসমান পাথর উত্তোলন খুবই বিপজ্জনক পানির উৎসের ক্ষেত্রে। তাই এসব পানির উৎস ধংস করা থেকে বিরত থাকা দরকার। এসব রোধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা না গেলে পার্বত্য তিন জেলায় প্রাকৃতিক খাবার ও ব্যবহারের পানির মহাসংকট দেখা দিতে পারে অচিরেই।
পাঠকের মতামত: